আবু দারদা
আবু দারদা আরবি: أبيْ الدّرْداء رضى الله عنْه | |
---|---|
খেতাব: উয়াইমির হাকীমু উম্মাতি, নি’মাল ফারিসু ’উয়াইমির, কানা মিনাল উলামা আল-হুকামা | |
জন্মস্থান | মদীনা |
যে জন্য পরিচিত | মুহাম্মদ এর একজন বিশ্বস্ত সহচর এবং একজন মহাজ্ঞানী হাকীম |
প্রভাবিত | ঈশ্বর, মুহাম্মদ |
কবর স্থান | দিমাশ্কের ‘বাবুস সাগীর’-এর নিকট[১] |
ধর্ম | ইসলাম |
সম্প্রদায় | মুসলিম |
আবু দারদা আনসারী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর একজন বিখ্যাত সাহাবী। কন্যা দারদার নাম অনুসারে এ নাম এবং ইতিহাসে এ নামেই খ্যাত। তিনি ছিলেন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, অশ্বারোহী ও বিচারক। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ছিলেন মদীনার একজন সফল ব্যবসায়ী।
জীবনী
[সম্পাদনা]আবু দারদা’ নামে আমরা যে বিখ্যাত সাহাবিকে চিনি তার প্রকৃত নাম ‘উইয়াইমির’। কন্যা ‘দারদা’ এর নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার উপনাম ‘আবু দারদা’। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তিনি ‘হাকিমুল উম্মহ’ বা ‘উম্মতের দার্শনিক’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।[২] কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ফারায়েজ, হিসাববিজ্ঞান এবং আরবি কাব্য-সাহিত্যে বিজ্ঞ আলেম এ বিদগ্ধ সাহাবি ছিলেন পবিত্র কোরআন সংকলকদের মধ্যে অন্যতম। পবিত্র কোরআনের পা-িত্যের কারণে তাকে ‘সাইয়েদুল কুররা’ও বলা হতো। জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি সময় তিনি দামেস্কের বিচারকও নিযুক্ত ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের আগে আবু দারদা মূর্তিপূজক ছিলেন। প্রথম হিজরি সনে বদর অভিযান চলাকালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ওই দিন আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা এবং মুহাম্মাদ বিন মাসলামা তার বাড়িতে ঢুকে প্রতিমাগুলো ভেঙে ফেলেন। ভাঙা মূর্তির টুকরোগুলো একত্রিত করতে করতে তিনি বলতে লাগলেন, নিজের ক্ষতিটুকু প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তোমাদের নেই! তোমরা নাশ হও! এ সময় তার স্ত্রীও তাকে জোরালো সমর্থন করলেন। এ ঘটনা আবু দারদা এর মনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। তৎক্ষণাৎ তিনি গোসল করে মুহাম্মাদ এর দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা তাকে আসতে দেখে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আবু দারদা প্রতিশোধ নিতে আসছে। নবীজি বললেন, না, সে ইসলাম গ্রহণ করতে আসছে। আমার পালনকর্তা তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। [৩] একবার ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান আমিরুল মুমিনিন ওমর এর কাছে এই মর্মে পত্র প্রেরণ করেন যে, দিন দিন শামের জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। তাই জনগণের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক-মন্ডলীর প্রয়োজন। অতএব কোরআন-হাদিসে প্রাজ্ঞ এবং শিক্ষাদানে অভিজ্ঞ ব্যক্তির একটি দল উল্লেখিত এলাকার উদ্দেশে প্রেরণের আবেদন করছি। আমিরুল মুমিনিন কালক্ষেপণ না করে আবু আইয়ুব আনসারি, উবাই বিন কাআব, মুআজ বিন জাবাল, উবাদাহ বিন সামেত এবং আবু দারদা কে দরবারে ডেকে পাঠালেন। তাদের ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ানের পত্র পাঠ করে শুনিয়ে বললেন, আপনাদের মধ্যে থেকে যে কোনো তিনজন এ গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিন। তারা বললেন, আবু আউয়ুব আনসারি এবং উবাই ইবনে কাব বার্ধক্য, রুগ্ণতা ও দুর্বলতার কারণে এ দায়িত্ব পালনের উপযোগী নন। আমরা অবশিষ্ট তিনজন এ মহান দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে অচিরেই শাম অভিমুখে রওয়ানা হবো। এরপর তারা খলিফা ওমর এর নির্দেশনা অনুযায়ী হিমসে কিছু দিন অবস্থান করলেন। এরপর উবাদাহ বিন সামেতকে সেখানে রেখে আবু দারদা দামেস্কের উদ্দেশে এবং মুআয ফিলিস্তিনের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আবু দারদা ওই সময় থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত দামেস্কেই অবস্থান করেছেন। [৪] আবু দারদা দামেস্কে পৌঁছে জামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিদিন ফজরের পরে তিনি পবিত্র কোরআনের দরস দিতেন। একদিন তিনি নিজ মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা গণনা করে দেখলেন যে, ছাত্রসংখ্যা ১৬০০ ছাড়িয়ে গেছে।[৫] আবু দারদা পবিত্র কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ফারায়েজ, হিসাববিজ্ঞান এবং আরবি কাব্যের বিশেষজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি উল্লিখিত শাস্ত্রগুলোর পাঠদানও করতেন। আবদুল্লাহ বিন সাঈদ বলেন, একবার আমি আবু দারদা কে মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতে দেখলাম। তার সঙ্গে অনুসারীরাও সেখানে প্রবেশ করছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, কোনো বাদশাহর সঙ্গে তার অনুচরবৃন্দ ও সভাসদরা চলছেন। তাদের কেউ তাকে মিরাস বিষয়ক প্রশ্ন করছিল, কেউ কাব্য সংক্রান্ত প্রশ্ন করছিল আবার কেউ বা হাদিস জিজ্ঞাসা করছিল। কেউ আবার দুর্বোধ্য মাসালার সমাধান জিজ্ঞাসা জানতে চাচ্ছিল।[৬] আবু দারদা এর জ্ঞান-গরিমা ও প্রজ্ঞার কারণে তিনি ‘হাকিমুল উম্মাহ’ বা ‘মুসলিম জাতির দার্শনিক’ উপাধিতে ভূষিত হন। প্রজ্ঞাপূর্ণ বহু বক্তব্য উল্লেখযোগ্য নানা গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তিনটি বিষয়কে মানুষ অপছন্দ করে কিন্তু আমি ওই তিনটি বিষয়কে ভালোবাসি। তা হলো, দারিদ্রতা, অসুস্থতা আর মৃত্যু। দারিদ্র্যতা, কেননা এর কারণেই আমি নিজেকে পালনকর্তার সামনে অক্ষম মনে করি। অসুস্থরা, কারণ তা আমার পাপ মোচন করে। মৃত্যু, কেননা শুধু এ পথেই আল্লাহর সাক্ষাতের আকাক্ষা পূর্ণ করা সম্ভব।’ [৭] তিনি আরও বলেন, যদি তিনটি বিষয় আমার জন্য সহজলভ্য না হতো তবে আমি দুনিয়ায় থাকা পছন্দ করতাম না। এক. রোজার কারণে দুপুরের তীব্র পিপাসা। দুই. রাতে আল্লাহর দরবারে সেজদায় নিমগ্নতা। তিন. উৎকৃষ্ট খেজুর গ্রহণ করার মতো ভালো কথা গ্রহণ করা মানুষের সান্নিধ্য।[৮]
আবু দারদা অসুস্থ হয়ে পড়লে এক সাথী তার রোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি আমার গোনাহের রোগে আক্রান্ত। এরপর তার মনের চাহিদার কথা জানতের চাইলে তিনি বললেন, আমার একমাত্র চাহিদা ‘জান্নাত’।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]
- ↑ আল-ইসতী’য়াবঃ টীকা আল-ইসাবা- ২/৪৬; ৪/৬০; উসুদুল গাবা- ৫/১৮৬; ’আল-আ’লাম- ৫/২৮১; তারীখুল ইসলাম- ২/১১১; দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ১/৮০১; তাহজীবুত তাহজীব- ৮/১৫৬; শাজারাতুজ জাহাব- ৫/৩৯
- ↑ (তাহজিবুত তাহজিব : ৮/১৭৫)।
- ↑ (আল মুসতাদরাক : ৩/৩৩৬-৩৩৭)।
- ↑ (তবাকাতে ইবনে ছাআদ : ২/৩৫৬/৩৫৭; সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/২৪৪)।
- ↑ (সিয়ারু আলমিন নুবালা : ২/৩৪৬)
- ↑ (কিতাবুল জারহি ওয়াত তাদিল : ৩/২:২৭)।
- ↑ (তবাকাতে ইবনে সাআদ : ৭/৩৯২)।
- ↑ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/৩৪৯)।
- ↑ (হিলয়াতুল আউলিয়া-২/২১৮)। (তবাকাতে ইবনে সাআদ : ২/৩৯৩)।