মোহাম্মদ খোরশেদ আলম
মোহাম্মদ খোরশেদ আলম | |
---|---|
জন্ম | ১ জুলাই ১৯৫১ |
মৃত্যু | ২৬ জুন ২০২১ | (বয়স ৬৯)
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
পরিচিতির কারণ | বীর প্রতীক |
মোহাম্মদ খোরশেদ আলম (১ জুলাই ১৯৫১ - ২৬ জুন ২০২১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ২৯৫, গেজেটে নাম মোহাম্মদ খুরশেদ আলম।[১]
জন্ম ও পরিবার
[সম্পাদনা]মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের জন্ম কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামে। তার পিতার নাম সাদত আলী। মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। স্ত্রীর নাম সুলতানা বেগম। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময় থেকে তিনি তার বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ, জাকির হোসেন সড়কের সুফিয়া মঞ্জিলে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
কর্মজীবন
[সম্পাদনা]১৯৭১ সালে তিনি শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তিনি ৬ দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ছাত্রলীগ পূর্ব নাসিরাবাদ শাখার সহ-সভাপতি এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়ে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর ৭ই মর্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী(সাবেক শ্রমমন্ত্রী), এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান, এনায়েত উল্লাহ্ মওলা প্রমুখের নেতৃত্বে ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা ও ট্রেনিং গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতের পলাশীতে নৌ কমান্ডোর প্রশিক্ষণ নেন। অপারেশন জ্যাকপটের অধীনে চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশনে শত্রু বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সকল কমান্ডোদের এবং অস্ত্রসস্ত্র সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে পৌছানোর দায়িত্ব পালন করেন। তার সুকৌশলী সিদ্ধান্তে অপারেশন জ্যাকপট সফলতার দিকে এগিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে তিনি মধ্যপ্রাচ্য গমন করেন এবং সেখান থেকে ফিরে ঠিকাদারী ব্যবসা করেন। পরবর্তীতে তিনি পোল্ট্রী ও কৃষি ব্যাবসয় জড়িয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
[সম্পাদনা]নৌ কমান্ডো ট্রেনিং শেষে প্রথমে যে ৬০জনের দল আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতের হরিনা ক্যাম্প থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন চালানোর জন্য রওনা হয়, মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সেই দলের সদস্য। ৬০জনের দলকে আবার ২০জন করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এমনই একটি উপদলের সদস্য হয়ে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্যেশ্যে রওনা দেন। নিশুতি অন্ধকারে পাহাড়ী জঙ্গল পার হয়ে মুহুরী নদী পার হয়ে নদীর তীরবর্তী রাম কৃষ্ণমন্দার বাজার এলাকায় উপদলটি যখন পৌছে রাত তখন প্রায় শেষ। রাতভর পাহাড়ী নদী ও কর্দমাক্ত পথ চলে সবাই ক্লান্ত। এ ছাড়া সকলের কাছে রয়েছে একটি লিমপেট মাইন, ফিনস্, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ, শুকনো খাবার, কাপড় চোপড় ইত্যাদি। সব মিলিয়ে প্রায় ২০কেজির একটি বোঝা। তার পরেও কমান্ডোদের মনোবল এতটুকু কমে নাই। স্থানীয় হিসেবে মোহাম্মদ খোরশেদ আলম এবং ডাঃ শাহ্ আলমকে অন্য সকল কমান্ডোদের গাইড করার দায়িত্ব দেয়া হয়। চলার পথে তারা মীরসরাই ইছাখালী প্রচন্ড গোলাগুলি এবং হেলিকপ্টার আক্রমণের শিকার হন। ফলে তাদের যাত্রা বাধা পড়ে। এসময় দলনেতা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর সাথে পরামর্শক্রমে মোহাম্মদ খোরশেদ আলম এস.এম.ইউসুপের(প্রক্ষাত ছাত্রনেতা) দেয়া একটি চিঠি নিয়ে ২৪ঘণ্টা সময় নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে ঢুকে মৌলভী সৈয়দের সাথে দেখা করেন এবং কি করে নৌ কমান্ডোদের কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে পৌঁছানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করেন। পরে মৌলভী সৈয়দের নির্দেশে আবু সাইদ সর্দার সকল নৌ-কমান্ডোদেরকে শহরের বিভিন্ন স্হানে আশ্রয়ের ব্যাবস্হা করেন। শহরের যতো কাছাকাছি কমান্ডোরা যাচ্ছেন বিপদও ততোই বাড়ছে। ১৩ই আগস্ট ১৯৭১ সন্ধার মধ্যে ২টি উপদলের সকল সদস্য আলকরণের মতিন টেইলার্সে এসে পৌঁছে। সেখান থেকে আগ্রাবাদে মমতাজ মহলে, নাসিরাবাদ এলাকার ও.আর.নিজাম রোডের কাকলি বিল্ডিংএ, মৌলভী পাড়া, সবুজবাগ পানওয়ালা পাড়া, এম.পি ইসহাক সাহেবের বাড়ী, কমান্ডো মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের বাড়ি সুফিয়া মন্জিলে, চক্-বাজার কবির সওদাগরের বাড়ী, আগ্রাবাদ ব্যাপারীপাড়া, রঙ্গীপাড়া, হাজীপাড়া ইত্যাদি স্হানে আশ্রয়ের ব্যাবস্হা করা হয়। কমান্ডো মোহাম্মদ খোরশেদ আলম ও শাহীন বিরনী হাউজের মালিক জানে আলম কমান্ডোদের আশ্রয়ের ব্যাপারে অসীম সাহসীকতা ও দক্ষতার পরিচয় দেন।[২][৩]
১৩ই আগস্ট] ১৯৭১ মোহাম্মদ খোরশেদ আলম ২টি প্রাইভেট কারের ব্যাবস্হা করে ডোমখালি থেকে অপারেশনে ব্যবহার করার জন্য ৬টি করে ১২টি মাইন এবং অন্যান্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসেন। সন্ধা ৭টার দিকে মোঃ খোরশেদ আলম, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, ডাঃ শাহ্ আলম জি.ই.সির মোড়ে কাকলী ভবনে আশ্রয় নেন। ঐ রাতেই, তারা ৩জন ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানের (ইস্টার্ণ রিফাইনারীর ইঞ্জিনিয়ার) গাড়ীতে করে ৩ জন কমান্ডো, ইঞ্জিঃ আজিজুর রহমান ও তার স্ত্রী শহরের বিভিন্ন স্হানে কমান্ডোদের অবস্হান পরিদর্শন করেন। একই রাতে কুমীরা থেকে বাকী গোলাবারুদ আনার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় ওয়াপদার (P.D.B) ইঞ্জিনিয়ার শাহাবুদ্দিন ও জানে আলমকে। তারা ১৪ই আগস্ট ১৯৭১ সকালে রওনা দেয়, কিন্তু দুপুর ১টায় ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসে। এরপর কমান্ডার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী মোঃ খোরশেদ আলমকে নির্দেশ দেন গোলাবারুদ আনার জন্য। ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান দিবস হওয়ায় সেনা তৎপরতা বেশি ছিলো। মোঃ খোরশেদ আলমও ব্যর্থ হয়ে দেওয়ান হাট মোড় থেকে ফিরে আসেন। এদিকে অপারেশনের দিন ঘনিয়ে আসছে, ১৩ই আগস্ট ১৯৭১ সকালেই রেডিওতে আকাশবানী থেকে পূর্বনির্ধারীত গান "আমি তোমায় যত শুনিয়ে ছিলাম গান।" বাজানো হয়ে গেছে।[৪] মোঃ খোরশেদ আলম ১৫ই আগস্ট ১৯৭১ আবার অস্ত্র আনতে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য তার কমান্ডারকে রাজী করান।
মৌলভী সৈয়দের নির্দেশে তার লোকেরা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, ডাঃ শাহ্ আলম, মোঃ খোরশেদ আলম ছাড়া বাকী সকল কমান্ডোদের ১৪ই আগস্ট ১৯৭১ রাতেই নিরাপদে কর্ণফুলী নদীর ওপারে পৌঁছে দেন। ১৪ই আগস্ট,১৯৭১ রাতে ইঞ্জিঃ আজিজুর রহমানের বাসায় চট্টগ্রাম শহরে থাকা তিন কমান্ডো মিলিত হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্হানরত জাহাজগুলো রেকি করার জন্য। ইঞ্জিঃ আজিজুর রহমানের অধস্তন ইঞ্জিঃ মতিন, কমান্ডার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, ডাঃ শাহ্ আলম বন্দর রেকির কাজ সেরে নেয়। ১৫ই আগস্ট ১৯৭১ ভোর ৬টায় মোঃ খোরশেদ আলম জানে আলমকে নিয়ে ওয়াপদার একটা গাড়ীতে করে বাকী গোলাবারুদ আনতে রওনা দেন। এদিকে সকালে আকাশবাণী থেকে পূর্বনির্ধারীত গান "আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুড় বাড়ী" বাজানো হয়ে গেছে। এমতাবস্হয় মোঃ খোরশেদ আলম এবং জানে আলম তরকারি পাইকারী বিক্রেতা সাজেন। বাকী ২৮টি মাইন গাড়ীতে উঠিয়ে ২খাঁচা বরবটি সীম মাইনগুলোর উপর বিছিয়ে দেন। শহরে ঢোকার পথে গ্লাক্সোর সামনে একজন পাকসেনা সিগন্যাল দেয়। তারা গাড়ী থামায়। পাকসেনার বিভিন্ন জেরার মধ্যে তারা নিজেদের সব্জী বিক্রেতা হিসেবে প্রমাণ করতে স্বক্ষম হোন এবং পার পেয়ে যান। তারা মাইনগুলো হাজীপাড়ায় নামান এবং হারিছ ভাই ও জালাল ভাইকে বুঝিয়ে দেন। হারিছ ভাই, জালাল ভাই তখনই মাইনগুলো নদীর ওপারে পৌছে দেন। এর পর মোঃ খোরশেদ আলম কাকলিতে ফিরে যান, এবং আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী ও ডাঃ শাহ্ আলমের সাথে দেখা করেন। তারা তাকে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে সন্ধায় নদীর ওপারে রওনা দিতে বলে নিজেরা তখনি নদীর ওপারের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেন। রাতে খোরশেদ আলম নদীর ওপরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু পথে দামপাড়ায় পাকবাহিনীর বাঁধার মুখে পড়ে দামপাড়ায় আত্বগোপনে বাধ্য হোন। ঐ রাতেই নৌ-কমান্ডোরা চট্টগ্রাম বন্দর কাঁপিয়ে তোলেন।
চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণের সফলতার পর নৌ-কমান্ডোরা বহিঃনোঙর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনায়ও মোঃ খোরশেদ আলম অংশ নেন।[৫]
পুরস্কার ও সম্মাননা
[সম্পাদনা]মৃত্যু
[সম্পাদনা]দীর্ঘসময় ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন খোরশেদ আলম। ২০২১ সালের ২৬ জুন রাত পৌনে তিনটায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ দৈনিক প্রথম আলো, তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না| তারিখ: ১৫-০২-২০১২[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ মুক্তিযুদ্ধ ও নৌ-কমান্ডো অভিযান। পৃঃ ৯৩ লেখক: কমান্ডো মোঃ খলিলুর রহমান
- ↑ জ্যাকপট ও সেদিনের নায়করা। দৈনিক আজাদী, তারিখঃ ১৬/১২/২০১৩[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ মুক্তিযুদ্ধ ও নৌ-কমান্ডো অভিযান। পৃঃ ৯৪ লেখক: কমান্ডো মোঃ খলিলুর রহমান
- ↑ মুক্তিযুদ্ধ ও নৌ-কমান্ডো অভিযান। পৃঃ ১০৩ লেখক: কমান্ডো মোঃ খলিলুর রহমান
- পাদটীকা
- এই নিবন্ধে দৈনিক প্রথম আলোতে ১৩-০২-২০১২ তারিখে প্রকাশিত তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না প্রতিবেদন থেকে লেখা অনুলিপি করা হয়েছে। যা দৈনিক প্রথম আলো ক্রিয়েটিভ কমন্স অ্যাট্রিবিউশন-শেয়ার-এলাইক ৩.০ আন্তর্জাতিক লাইসেন্সে উইকিপিডিয়ায় অবমুক্ত করেছে (অনুমতিপত্র)। প্রতিবেদনগুলি দৈনিক প্রথম আলোর মুক্তিযুদ্ধ ট্রাস্টের পক্ষে গ্রন্থনা করেছেন রাশেদুর রহমান (যিনি তারা রহমান নামেও পরিচিত)।